দূর বিশ্বের টানে আসিয়ান এস্ট্রোনমি ক্যাম্পে যাত্রা
মহাবিশ্বের বিশালতার প্রতি মুগ্ধতা, এর দূর-দূরান্তের রহস্যে ঘেরা মহাজাগতিক বস্তুসমূহের প্রতি কৌতূহল আহ্বান জানিয়েছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক ঝাঁক কিশোর-কিশোরীকে, গত ১১-১৪ মার্চ থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই শহরে ইউনেস্কো (ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং সেন্টার ইন এস্ট্রোনমি – আইটিসিএ) ও নারিট (ন্যাশনাল এস্ট্রোনমিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ থাইল্যান্ড) কর্তৃক আয়োজিত আসিয়ান এস্ট্রোনমি ক্যাম্পে (এএসি) অংশগ্রহণের। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমিও এপ্লাই করেছিলাম ক্যাম্পটিতে অংশগ্রহণ করার একটি সুযোগ পাওয়ার জন্য। ভাগ্যক্রমে সেই অমূল্য সুযোগটি আমি পেয়েও যাই। তারপর ৯ই মার্চ আমি থাইল্যান্ড গিয়ে পৌঁছাই। ক্যাম্পের কার্যক্রম যদিও শুরু হয় ১১ তারিখ থেকে কিন্তু আমরা সকল পার্টিসিপেন্টরা ১০ তারিখেই চিয়াং মাইয়ের ইবিস স্টাইলস হোটেলে গিয়ে একত্র হই। হোটেলে পৌঁছানোর পর একে একে অনেক সদস্যের সাথেই আমার পরিচয় হয় এবং রাতারাতিই আমাদের মাঝে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। সেদিন আমরা কয়েকজন পার্টিসিপেন্ট মিলে একটু ঘুরাঘুরিও করেছি। ঘুরাঘুরির পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে নানা আলোচনাও চলমান ছিল। একেকজনের একেক দৃষ্টিকোণ থেকে যেন জ্যোতির্বিজ্ঞানও আমার কাছে হরেকরকমের হয়ে উঠলো। যাই হোক, পরদিন সকালে ক্যাম্প অথোরিটির সদস্যরা এসে আমাদেরকে নিয়ে যায় প্রিন্সেস সিরিনধর্ন এস্ট্রো পার্কে। ওখানে পৌঁছেই সর্বপ্রথম আমরা প্রবেশ করি এন্ড্রমিডা হলে। এটা ছিল একটা সুন্দর হলরুমের মতো। সেখানেই আমাদের ক্যাম্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং প্রথম দিনের আরও অনেক আকর্ষণীয় ও শিক্ষণীয় হ্যান্ডস-অন এক্টিভিটি হয়। শুরুর দিকে আমাদের সকলের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নেওয়া হয়। এই পার্টটা আমার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে কেননা যখন আমি সংক্ষেপে আমার পরিচয় দেই এবং পাশাপাশি এই ক্যাম্প পর্যন্ত আমার পৌঁছানোর পেছনে ছোট্ট করে আমার মা-বাবার অবদানের কথা বলি তখন সবাই মিলে একটা হাততালি দেয় আমার আম্মু-আব্বুর জন্য। এতে আমি তখন কতটা আনন্দিত হয়েছিলাম সেটা হয়ত বলে বোঝানো সম্ভব হবে না।
তারপর শুরু হয় আমাদের নানান রকমের চিত্তাকর্ষক কার্যক্রম ও ওয়ার্কশপ। তার মধ্যে সব থেকে মজার যে দুইটা জিনিস ছিল সেগুলো হলো ছোট ইলেকট্রিক লাইট দিয়ে কাগজের বোর্ডের ওপর কনস্টেলেশন ডিজাইন করা এবং কৃত্রিম কমেট বানানো। তবে এসবের আগে আমাদেরকে একটা ছোট্ট তবে খুব সুন্দর লেকচারও দেওয়া হয় যেখানে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মূলত আকাশ পর্যবেক্ষণ নিয়ে বেসিক জিনিসগুলো সেখানো হয়। এটা ছিল ক্যাম্পের প্রথম ওয়ার্কশপ। এটার পর আমাদেরকে একটা ছোট্ট ব্রেক দেওয়া হয়; স্ন্যাকস ব্রেক। এতে ছিল থাইল্যান্ডের ট্রেডিশনাল স্ন্যাকস ও ড্রিংকস; যেমন, হরেক রকমের থাই ডেজার্ট, থাই চা, কফি এবং এর পাশাপাশি বিভিন্ন ফল ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলোর টেস্ট ভালই ছিল।
এই ব্রেকের পর আমাদেরকে একটা অনেক মজার গেইমের মাধ্যমে ছয়টি গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হয়। প্রতি গ্রুপে ছিল আটজন করে পার্টিসিপেন্ট। আমার গ্রুপ নম্বর ছিল ৬। গ্রুপ তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয় যেন প্রতি গ্রুপ থেকে একজনকে সামনে পাঠানো হয় গ্রুপের রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে। এর পেছনে কারণ ছিল গ্রুপ প্রেজেন্টেশনের টপিক সিলেক্ট করা। তো আমাদের গ্রুপ থেকে আমি যাই। আমাদের গ্রুপ প্রেজেন্টেশন এর টপিক হিসেবে আমি কোনটা পেয়েছিলাম সেটা এই লেখার শেষের দিকে জানতে পারবেন। তো এটার পর আমাদেরকে আরও একটি গেইম এর ব্যাপারে বলা হয়। এটা ছিল একটা ট্রিকস টাইপ গেইম যেখানে ৩ ধরনের কার্ড থাকবে : এলিয়েন, ব্ল্যাকহোল আর ক্রুমেট। একেকজনকে একেকটা দেওয়া হবে। সবাইকে তার কার্ডটি লুকিয়ে রাখতে হবে কেননা যাদের কপালে ব্ল্যাকহোল আর এলিয়েন কার্ড পড়েছে তাদেরকে এটা চেইঞ্জ করে ক্রুমেট কার্ডটি ম্যানেজ করতে হবে। কার্ড চেইঞ্জ করার জন্য কিছু মজার নিয়ম ছিল। আর আরেকজনকে ট্রিক করে তার থেকে ক্রুমেট কার্ডটি নেওয়ার জন্য সময় ছিল ক্যাম্পের শেষ দিন পর্যন্ত। তাই পুরো ক্যাম্প চলাকালীন সময়েই আমরা প্রায় সকলেই একজন আরেকজনকে ট্রিক করে কার্ড চেইঞ্জ করা, তারপর নিজে ট্রিকে পড়ে যাওয়া- এরকম অনেক মজার মজার ও আনন্দঘন কার্যক্রমে যুক্ত ছিলাম। আমার কথা যদি বলি তাহলে আমি দুইবার ট্রিক করেছি আর একবার নিজে ট্রিকড হয়েছি। বিষয়গুলো খুবই মজার ছিল। যাই হোক, এখন আসি প্রথম দিনের অন্যতম একটি আকর্ষণীয় এক্সপেরিমেন্টের কথায়; কনস্টেলেশন ডিজাইন। একটা কাগজের উপর কপার তার, ব্যাটারি ও ছোট ছোট ইলেকট্রিক লাইট ইউজ করে আমরা ওরায়ন ও ক্যাসিওপিয়া কনস্টেলেশন বানাই। এগুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল।
কনস্টেলেশন বানানোর কাজ শেষ হওয়ার পর আমাদেরকে দুপুরের খাবারের জন্য একটি ব্রেক দেওয়া হয় এবং আমরা সকলে মিলে লাঞ্চ করার জন্য এন্ড্রমিডা হল থেকে বের হয়ে এর সামনেই আয়োজন করা লাঞ্চ টেবিলে গিয়ে বসে পড়ি। লাঞ্চ করতে করতে সেখানে নতুন করে হয়ে ওঠা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিই, তাদের কালচার, ট্রেডিশন ইত্যাদির ব্যাপারে একটু-আধটু জেনে নিই আর পাশাপাশি হাসি-আনন্দ এসব তো পুরোদমেই চলছিল। লাঞ্চের পর আমাদের প্রায় ১৫-২০ মিনিটের মতো সময় দেওয়া হয় এস্ট্রো পার্কের যে বিল্ডিঙে এন্ড্রমিডা হলটা ছিল সেই বিল্ডিঙের অন্যান্য অংশ ঘুরে দেখা কিংবা চাইলে বসে রেস্ট নেওয়া। তো আমরা প্রায় সকলেই তখন ঘুরে ঘুরে সেই বিল্ডিংটার ভিতরে সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন জিনিস দেখেছি, এর পাশাপাশি ছবি তোলা, গল্প করা এসব তো ছিলই। সেখানে এস্টারয়েড, মেটিওর ও মেটিওরাইট রাখা ছিল। আরও অনেক কিছু ছিল। এসব ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর কত্ত যে আনন্দ পাচ্ছিলাম!
তাছাড়া সেই ফাঁকে আমি আমার গ্রুপমেটদের সাথে আমাদের গ্রুপ ওয়ার্ক নিয়েও আলোচনা করে নিচ্ছিলাম কিছুটা যেনো কাজ এগিয়ে রাখা যায় এবং গোছানোভাবে কাজটা সেরে ফেলা যায়। লাঞ্চ আর লাঞ্চের পরের এই ছোট্ট ব্রেকের পর আমাদের দ্বিতীয় ওয়ার্কশপ শুরু হয়। এটা বিশেষ করে আমার জন্য একটা রেয়ার সুযোগ ছিল কারণ এই ওয়ার্কশপে যা যা দেখানো আর শেখানো হয়েছিল সেগুলো দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। এই ওয়ার্কশপে আমাদেরকে তিনটা সেন্টার আর একটা ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেগুলোর নাম যদি বলি তবে এক নম্বরে ছিল এডভান্সড ইনোভেশন সেন্টার, তারপরে ছিল এডভান্সড মেকানিকেল ম্যানুফেকচারিং সেন্টার, তারপর প্রোটোটাইপ এন্ড টেকনোলজি ইনকিউবেশন সেন্টার এবং সবশেষে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল থিন-ফিল্ম টেকনোলজি ল্যাবরেটরিতে। এগুলোতে নিয়ে গিয়ে আমাদের দেখানো হয়েছিল নারিটের ইঞ্জিনিয়ার ও টেকনিশিয়ানদের নিজেদের বানানো নানা যন্ত্রপাতি, এসবের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, এগুলোর কাজ, এগুলোর উপাদান ইত্যাদি।
এছাড়াও এদের রেডিও টেলিস্কোপগুলো কীভাবে তৈরি এবং কীভাবে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় ইত্যাদিও আমাদের কাছে বলা হয়। এই জিনিসগুলো দেখার সময় আমি আমাদের ইন্সট্রাকটরদেরকে অনেক প্রশ্ন করছিলাম এবং তারাও খুব সুন্দর করে আমার কৌতুহল মেটাচ্ছিলেন। আর বিশেষ করে ল্যাবে যাওয়ার জন্য আমাদেরকে যেভাবে ড্রেসিং ও ক্লিনিং করানো হয় আর তারপর একটার পর একটা স্টেজ পার হয়ে যখন ল্যাবে ঢুকি তখন কি যে এক্সাইটেড ফিল হচ্ছিলো! ওখানেও অনেক কিছু শিখি, দেখি ও জানার চেষ্টা করি।
এই কার্যক্রমটি শেষ হওয়ার পর আমাদেরকে আবারও একটি স্ন্যাকস ব্রেক দেওয়া হয়। এই ব্রেকের পর শুরু হয় খুবই চমৎকার একটা জিনিস!
ব্রেকের পর আমাদের সকলকে একটা ডেমো দেখানো হয় কৃত্রিম কমেট বানানো নিয়ে। সেটার পর প্রত্যেক গ্রুপের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় কমেট বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপাদান। তার মধ্যে ছিল ড্রাই আইস, কোল্ড ড্রিংকস, পানি, তরল এমোনিয়া, ধূলিকণা ও পাথুরে মাটি এবং সয়া সস। আমরা একে একে সবগুলো উপাদান পরিমাণ মতো একটা পুরু পলিথিনের ব্যাগে মিশিয়ে সবশেষে ড্রাই আইসটা যোগ করি। এটা ছিল একটা ইন্টারেস্টিং পার্ট। ড্রাই আইস যেহেতু খুব ঠান্ডা তাই এটা থেকে শীতল ধোঁয়া বের হচ্ছিল। আর এই সব মিলিয়ে যে পরিবেশটা তৈরি হয়েছিল সেটা সত্যিই একটা অন্যরকম অনুভূতি দিচ্ছিল। তো যাই হোক, তারপর আমরা পলিথিনের ব্যাগটাকে চাপ দিয়ে ধরে রাখি কয়েক মিনিট যাবৎ এবং আমাদের কমেট রেডি! ইয়েএএ!
সব গ্রুপেরই কমেট বানানো সম্পন্ন হওয়ার পর কমেটগুলো নিয়ে প্রতি গ্রুপ থেকে একজন করে স্টেজে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়। আমার গ্রুপ থেকে আমাদের কমেটটি আমি সকলের সামনে নিয়ে যাই। সামনে যাওয়ার পর গ্রুপ-১ থেকে শুরু করে আমাদেরকে একে একে জিজ্ঞাসা করা হয় যে আমাদের বানানো কমেটের নাম কী? আমি তো তখন কিছু মুহূর্তের জন্য বেজায় মুশকিলে পড়ে যাই। কারণ আমাদের গ্রুপে আমরা কমেটটির নামের ব্যাপারে কোনো আলোচনা করিনি। তাই বাকিরা তাদের কমেটের নাম বলতে বলতে আমি তখন মনে মনে একটা নাম ভেবে নিই। আর যখন আমার পালা আসে তখন আমি সেই নামটি মাইক দিয়ে বলি। তো আমি যে নামটি দিয়েছিলাম আমাদের কমেটটার সেই নামটি হলো ফ্রেন্ডস৬। এর সাথে আমি ছোট্ট করে একটি ব্যাখ্যাও জুড়ে দিই। আমি বলেছিলাম যে, এই কমেটটি বানানোর সময় আমাদের গ্রুপের সদস্যদের মাঝে বন্ধুত্বটা আরও জোড়ালো হয় আর যেহেতু আমাদের গ্রুপ নম্বর ৬ তাই আমাদের কমেটটির নাম ফ্রেন্ডস৬! ব্যাখ্যাটি শোনার পর সকলে মিলে একটা করতালি দেয় এবং আমাদের কমেট বানানোর ইন্সট্রাক্টর আমাকে বলে যে আমাদের কমেটের নামটা যেমন সুন্দর হয়েছে তেমনি আমাদের কমেটটাও অনেক সুন্দর হয়েছে। এই ব্যাপারটা আমার কনফিডেন্স লেভেলকে একটু বাড়িয়ে দেয় আর বিশেষ করে আমার দেওয়া নামটি আমার গ্রুপ মেম্বারদের পছন্দ হয়েছে দেখে একটু রিলিভড ফিলও হয় যে না গ্রুপের রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে আমি ওদেরকে হতাশ করিনি। তো এভাবে সম্পন্ন হয় আমাদের তৃতীয় ওয়ার্কশপ।
এটার পর আমি যেটা এক্সপেরিয়েন্স করি সেটা শুধু এই ক্যাম্পের না আমার পুরো লাইফের সেরা জিনিসগুলোর মধ্যে একটা। প্ল্যানেটারিয়াম শো এবং সেলেস্টিয়াল স্ফিয়ার; কি যে সুন্দর ছিল এটা!
নারিটের প্ল্যানেটারিয়ামটার ভিতরে ঢুকতেই অন্য রকম একটা অনুভূতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমরা সবাই গিয়ে একে একে সিটে বসে পড়ি। সিটগুলো ছিল একদম হেলানো। আর তারপর যখন আমরা হেলান দিয়ে এক প্রকার শুয়ে পড়ি আর চোখ মেলে উপরের দিকে তাকাই তখন আমি যা দেখতে পাই সেটা ছিল অসম্ভব সুন্দর একটা দৃশ্য! তারাভরা এক উজ্জ্বল আকাশ! মুহূর্তেই চারপাশ ঘিরে তৈরি হয়ে যায় এক শান্তিময় নিরবতা। যেন মনে হচ্ছিল মাঝরাতে খোলা মাঠে আমি একা নির্ভয়ে শুয়ে শুয়ে রাতের সুন্দর তারাময় জ্বলমল করা আকাশ উপভোগ করছি। একজন মেয়ে হয়ে আমাদের দেশে এরূপ অনুভূতি বাস্তবিকভাবে অনুভব করা আমার মনে হয় না সম্ভব কেননা এখানে মাঝরাতে একটা মেয়ের একা খোলা মাঠে নির্ভয়ে শুয়ে থাকার মতো কোনো স্কোপ নেই বললেই চলে। তাই সেই পরম শান্তিটা এখানে ফিল করা পসিবল না বলে আমার মনে হয়। কিন্তু এএসি আমায় সেই পরম সুখকর এক নিরাপদ শান্তিময় অনুভূতি অনুভব করতে দিয়েছিল। যখন তারাগুলো মুভ করছিল, চারপাশ থেকে একটা নির্মল প্রকৃতির শব্দ ভেসে আসছিল তখন আমার চোখের কোণ ভিজিয়ে দুফোঁটা জল পড়তে বাধ্য হয়েছিল আনন্দে। এরকম সুখ আমি এর আগে অনুভব করেছি কিনা জানিনা। এটা সত্যিই বেস্ট ছিল। যে-ই এটার সুযোগ পাবে, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের মেয়েরা, তারা হবে অত্যন্ত সৌভাগ্যের অধিকারী। কারণ এমন সুযোগ ওখানে না গেলে এই দেশে হয়ত আমি কখনোই পেতাম না।
এই প্ল্যানেটারিয়াম শো-তে আমাদেরকে অনেকগুলো কনস্টেলেশন চেনানো হয়, সেগুলো নিয়ে অল্পস্বল্প আলোচনা করা হয়, স্টার চার্ট ইউজ করা শেখানো হয়, একটা ছোট্ট প্ল্যানেটারিয়াম মুভিও দেখানো হয়। আর এই সবকিছুই আমরা উপভোগ করেছিলাম আমাদের দৃষ্টি বরাবর উপরের দিকে থাকা সেই চমৎকার আকাশটির পানে চেয়ে। পেছন থেকে মাইক দিয়ে ইন্সট্রাকটর আমাদেরকে বিভিন্ন জিনিস বলছিল, শেখাচ্ছিল, মাঝে মাঝে প্রশ্নও করছিল। এত মনোরম একটা পরিবেশ ছিল! আমি এটার অভিজ্ঞতা কখনোই ভুলতে পারব না। আমি আবারও যেতে চাই সেই প্ল্যানেটারিয়ামে, বিশেষ করে ঐ ক্যাম্পে হয়ে উঠা আমার বন্ধুদের নিয়ে। কিন্তু সেই সুযোগ কি আর কখনো হবে?
প্ল্যানেটারিয়াম শো শেষ হওয়ার পর আমরা কয়েকজন মিলে ইন্সট্রাকটর এর কাছে গিয়ে আরও কিছু জিনিস জেনে নিই। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে আমরা সবাই একসাথে ছবি তুলি। আর তারপর যাই ডিনার করতে। যদিও তখন ৬টাও বাজেনি, কিন্তু ওরা নাকি এই টাইমেই ডিনার করে। ফার্স্টে শুনে খুব অদ্ভূত লেগেছিল। যাই হোক, ডিনার করতে করতে আমরা সবাই মিলে মাথার ওপরে আকাশ দিয়ে যাওয়া একটি স্যাটেলাইটও একঝাঁক মুগ্ধতা নিয়ে দেখে ফেললাম। এরপর ডিনার সেড়ে আমরা যাই টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণে। সেদিন টেলিস্কোপগুলো ওরাই মাউন্ট ও এলাইন করে রেখেছিল এবং এক একটা টেলিস্কোপ আগে থেকেই এক একটা অব্জেক্টের দিকে তাক করে রাখা হয়েছিল। আমরা গিয়ে সেগুলো দেখলাম, তারপর অনেকে তাদের ফোন দিয়ে চাঁদ, জুপিটার ইত্যাদির ছবিও তুলল। তারপর আমরা ছাদে বসে বেশ কয়েকজন ফ্রেন্ড মিলে আড্ডা দিলাম, অনেক মজা করলাম। ওহ হ্যাঁ, এরই ফাঁকে আমি একজনকে ট্রিক করে তার কাছ থেকে ক্রুমেট কার্ডটিও নিয়ে নেই। আর আমার এলিয়েন কার্ডটি তার কাছে যায়। খুব মজা লাগছিল তখন।
যাই হোক, সেদিন আকাশে মেঘ জমে যাওয়ায় বেশিক্ষণ আর স্টারগেজিং করা সম্ভব হয়নি। তাই ৯টার মধ্যেই আমরা আবার হোটেলে ফিরে আসি। কিন্তু আমি আর আমার সাথের কয়েকজন ফ্রেন্ড – আমাদের কারোরই হোটেলের রুমে গিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছা করছিল না। তাই আমরা সবাই ঝটপট ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে পড়ি চিয়াং মাই শহরটা আবারও একটু ঘুরে দেখতে। তখন আমার সাথে ছিল আমার রুমমেট সোরা; সে ছিল জাপানের, আর ছিল ইন্ডিয়া থেকে আশা কৃষি এবং কম্বোডিয়ার দুজন ফ্রেন্ড; সাৎছশা আর ন্যাঁ। আমরা পাঁচজন মিলে রাতের বেলায় হেঁটে হেঁটে ওয়ান নিমানে যাই। এটা একটা সুন্দর জায়গাই ছিল। যদিও এটাতে আমি এর আগের দিনও যাই তবে তখন গিয়েছিলাম একা। ওদের সাথে গিয়ে আরও এনজয় করেছি।
তারপর প্রায় ১১টার পর আমরা হোটেলে এসে পৌঁছাই। এভাবে শত আনন্দময় ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে শেষ হয় এএসিতে আমার প্রথম দিন।
ক্যাম্পের দ্বিতীয় দিন সকালেই আমরা ইবিস স্টাইলস হোটেল থেকে একেবারে বেরিয়ে পড়ি থাই ন্যাশনাল রেডিও অব্জার্ভেটরিতে যাওয়ার জন্য। ওখানে গিয়ে আমরা ২.৪-মিটার অপ্টিকেল টেলিস্কোপ ও অব্জার্ভেটরি দেখি এবং আরও অনেক কিছু শিখি এগুলোর ব্যাপারে। এসবের ফাঁকে একটা ছোট্ট ব্রেকও দেওয়া হয় এবং আমাদের প্রত্যেক পার্টিসিপেন্টদের ছবি তোলানো হয়। আবার গ্রুপ ফটোও তোলা হয়। তারপর সেখান থেকে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় অনেক সুন্দর একটা জায়গায় লাঞ্চের জন্য। ওটা হোটেল বা রেস্টুরেন্টের মতো ছিল না। বেশ কয়েকটি বিল্ডিং একটু প্রত্নতাত্ত্বিক টাইপের, এর মধ্যে একটার ভেতর গিয়ে আমরা লাঞ্চ করি। খুব সুন্দর ছিল জায়গাটা, যেন একটা জংগলের ভেতরে। যাই হোক, লাঞ্চ শেষে আমাদেরকে অনেক সুন্দর একটা জিনিস দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয় যেটা হলো ওয়াচিরথন জলপ্রপাত।
এই ঝর্ণাটা অসম্ভব সুন্দর ছিল! আমরা সবাই ওখানে গিয়ে খুব আনন্দিত হয়েছিলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝরনা দেখা, বন্ধুরা মিলে এর আশেপাশের জায়গাগুলো ঘুরে দেখা, ছবি তোলা, হাসি-তামাশা, সব মিলিয়ে খুব এনজয় করছিলাম আমরা সবাই-ই। আর আমার ব্যক্তিগতভাবেও পাহাড়, ঝরনা এসব অনেক বেশি-ই ভাল লাগে। তাই আমার কাছে আরও খুশি লাগছিল এত্ত সুন্দর প্রকৃতি দেখতে পেয়ে।
এরই মাঝে প্রায় বিকাল ৩টা বেজে বেজে যায় আর তখন আমরা রওয়ানা দেই দোই ইন্থানন ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশ্যে। সেটা ওয়াচিরথন জলপ্রপাত থেকে বেশি দূরে ছিল না। তাই আমরা ৩টা নাগাদই ওখানে পৌঁছে যাই। শুরুতেই আমরা প্রবেশ করি ওখানের এস্ট্রোনমারস লজে। ওটা এক ধরনের ক্লাসরুমের মতো ছিল। সেখানে আমাদেরকে প্রথমে বলে দেওয়া হয় সেদিনের পরবর্তী এক্টিভিটিগুলো সম্পর্কে। আর তারপর আমাদেরকে কিছু সময় দেওয়া হয় আমাদের গ্রুপ প্রেজেন্টেশনের জন্য আলোচনা ও কাজ করতে। তখন আমি আমার গ্রুপ মেম্বারদের সাথে আমাদের প্রেজেন্টেশনের টপিক নিয়ে আলোচনা করি। নিজের আইডিয়াগুলো শেয়ার করি, ওদের আইডিয়াগুলো শুনি। এসবের সাথে সাথে যেন আমাদের বন্ধুত্বটা আরও জমে যায়! এরই মাঝে আমাদেরকে একটি কফি ব্রেকও দেওয়া হয়। কফি ব্রেক হলেও কয়েক রকমের স্ন্যাকসও ছিল, বিভিন্ন ফল ছিল। এগুলো ক্যাম্প এক্টিভিটির মাঝে সত্যিই এনার্জি দিতো। তো এই কফি ব্রেক এর পর শুরু হয় আমাদের ওয়ার্কশপ-৪।
এটা ছিল কীভাবে ডবসোনিয়ান টেলিস্কোপ ব্যবহার করতে হয় সেই টপিকের উপর। এটার জন্য আমাদেরকে একটা সুন্দর ভিডিও দেখানো হয় যেখানে ডবসোনিয়ান টেলিস্কোপ মাউন্ট করা থেকে শুরু করে এলাইন করা এবং তারপর কীভাবে সেটা দিয়ে স্টারগেজিং করতে হয় সেসব দেখানো হয়। ভিডিওটা খুবই কার্যকরী ছিল, তাই আমরা প্রায় সকলেই কেবল ভিডিও দেখেই অনেকটা শিখে যাই কীভাবে ডবসোনিয়ান ইউজ করতে হয়। তো এই ছোট্ট ভিডিও দেখানোর পর আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় একদম হাতে কলমে শেখানোর জন্য। একটা প্রায় বিশাল বড় মাঠে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে ৬টি দলের জন্য ৬টি বক্স রাখা ছিল যেগুলোর ভেতর ছিল ৬টি ডবসোনিয়ান। দলপ্রতি একজন করে গাইডও ছিলেন। তো আমরা প্রথমে নিজেরাই চেষ্টা করি টেলিস্কোপের মাউন্ট করার ও সেটাকে এলাইন করার। মাউন্ট নিজে নিজে করতে পারলেও এলাইন করার সময় আমাদের সকলেরই কম-বেশি গাইডের কাছ থেকে হেল্প নিতে হয়েছিল। উনারা খুব হেল্পফুল আর বন্ধুসুলভ ছিলেন। যাই হোক, এলাইন করা হয়ে গেলে আমরা ওটা দিয়ে বিভিন্ন অদ্ভুত জিনিস দেখি। অদ্ভুত বললাম কারণ তখনও রাত হয়নি, বিকাল ছিল। তাই আমরা আকাশের তারা না দেখে আশেপাশের গাছের সর্বোচ্চ শাখা-প্রশাখা, টাওয়ারের চূড়া, গাছের ডালে বসে থাকা পাখি, এরকম আরও অনেক মজার মজার জিনিস অব্জার্ভ করছিলাম।
এসব করতে করতেই আমরা যেন খুব অভ্যস্ত হয়ে যাই ডবসোনিয়ানের সাথে। আর তখনই আমাদের পুরো ক্যাম্প জুড়ে যে মেইন ইন্সট্রাক্টর ছিলেন তিনি মাইক দিয়ে ঘোষণা করেন একটা খুব ইন্টারেস্টিং গেইমের কথা। আসলেই খুব মজার ছিল গেইমটা। তো গেইমটা ছিল এরকম যে প্রতি দল থেকে একজন করে করে সামনে যাবে, গিয়ে ইন্সট্রাক্টরদের কাছ থেকে একটা করে কাগজ নিবে যেটাতে কোনো একটা ইংরেজি বর্ণ লেখা থাকবে। তারা এটা নিয়ে একেকজন মাঠের একেক প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াবে। আর প্রতি দল থেকে বাকি মেম্বাররা একজন একজন করে ডবসোনিয়ান ইউজ করে সেই বর্ণগুলো দেখে সেগুলো দিয়ে কোন শব্দ বা শব্দগুচ্ছকে বোঝানো হচ্ছে সেটা বের করে ইন্সট্রাক্টরকে জানাবে। যে দল আগে জানাবে তারা এক পয়েন্ট করে পাবে। এভাবে প্রায় ৪/৫টা শব্দ নিয়ে খেলা হয়। মজার এই গেইমটির মাধ্যমে দ্রুততার সাথে টেলিস্কোপটি ব্যবহার করার একটা ট্রেনিং পেয়ে যাই আসলে। শেষ হয় আমাদের ওয়ার্কশপ-৪।
তারপর খুব অল্প কিছুক্ষণের জন্য একটু অবসর দেওয়া হয় আর এরপরই নিয়ে যাওয়া হয় ডিনারের জন্য। সেটাও দোই ইন্থাননের ভেতরেই ছিল। সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ আমাদের ডিনার পর্ব শেষ হয়ে যায়। অবশ্য এর মাঝেই রাত হয়ে যায়। আর তখনই শুরু হয় ক্যাম্পের সবচেয়ে লোমহর্ষক পার্ট! লোমহর্ষক কেনো বললাম সেটা একটু পরই বুঝতে পারবেন।
আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় থাইল্যান্ডের সবচেয়ে উঁচু পয়েন্টে স্টারগেজিঙের জন্য। সেখানে তাপমাত্রা এতই নিচে ছিল যে মোটা মোটা সোয়েটার-মাফলার গায়ে জড়িয়েও ঠাণ্ডায় আমাদের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। সবাই কনকনে শীতে কাঁপছিলাম রীতিমত। তবুও খুব ভাল লাগছিল। প্রথমেই আমরা প্রত্যেক গ্রুপের সদস্যরা আমাদের গ্রুপের জন্য বরাদ্দ করা টেলিস্কোপগুলো বের করে মাউন্ট করতে শুরু করি। প্রতিটা গ্রুপের জন্যই একজন করে ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন সাথে। কিন্তু কাজ আমরা নিজেরাই করছিলাম। হাড় কাঁপানো শীতের মাঝে টেলিস্কোপটি বের করে মাউন্ট করা তারপর সেটাকে এলাইন করা — অন্যরকমের একটা অনুভূতি ছিল। আকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য টেলিস্কোপগুলোকে একেবারে সেট করার পর আমাদের ইন্সট্রাক্টররা আমাদেরকে দিয়ে চাঁদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন কনস্টেলেশন, যেমন ওরায়ন, প্লিয়াডিস, বিগ ডিপার, কয়েকটি গ্রহ ও তারা, ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করান। পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি আমরা কয়েকটা অবজেক্টের ছবিও তুলি। এসবের মাঝে একটা স্ন্যাকস ব্রেক দেওয়া হয়। বাইরের এই কনকনে ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে যখন স্ন্যাকস নেওয়ার জন্য স্টোরে যাই, তখন সবাই-ই যেন একটু রেহাই পেয়েছি মনে হচ্ছিল। কিন্তু তবুও এত শীতে স্টারগেজিঙের জন্য বিরক্তি কাজ করছিল না বরং সবাই খুব এনজয় করছিলাম।
তো সেদিন এভাবে স্টারগেজিং পর্ব শেষ হলে আমরা ছয়টা গ্রুপ নিজেদের গ্রুপের গাড়ি করে দোই ইন্থাননে আমাদের যে থাকার জায়গাটা ছিল সেখানে চলে যাই, গিয়ে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হই এবং তারপর চলে যাই এস্ট্রোনমারস লজে। সেখানে মূলত আমরা আমাদের গ্রুপ প্রেজেন্টেশনের কাজ করার জন্য যাই। কিন্তু প্রায় ১২টা বাজতেই আমাদের গাইডরা আমাদেরকে নিজেদের রুমে ফিরে যেতে বলল, কেননা সেই রুমটা তখন বন্ধ করে ওদের ঘুমাতে যেতে হবে। আমাদের গ্রুপ প্রেজেন্টেশন এর কাজ তখনও সেরকম আগায়নি। তাই আমি আমার টিমমেটদেরকে সাজেস্ট করি আমার রুমে আসতে, সেখানে আমরা বসে কাজ করতে পারব। তারপর আমি আর আমার টিমমেটরা মিলে আমার রুমে গিয়ে আমাদের প্রেজেন্টেশন এর পোস্টার ডিজাইন করি। এটা শেষ করতে করতে প্রায় রাত দেড়টা বেজে যায়। কিছু কাজ তখনও বাকি ছিল কিন্তু সেটা আমরা পরের দিনের জন্য রেখে দিই। তারপর সবাই যার যার রুমে চলে যায় ঘুমাতে। এইতো শেষ হয়ে গেল এএসিতে আমাদের আরও একটি দিন। পোস্টার মেকিংয়ের সময় আমরা খুব মজা করেছি। অনেক হাস্যকর কিছু মুহুর্তও ছিল যেগুলো এখন মনে পড়লে হাসির চেয়ে বেশি মন খারাপই হয়, কারণ সেই স্বর্ণালী মুহূর্তগুলো তো আর কোনোদিন ফিরে পাবো না আমার সেই বন্ধুদের সাথে। আফসোস!
পরদিন সকাল ৭টার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। শুরু হয়ে গেল ক্যাম্পের তৃতীয় দিন। ফ্রেশ হয়ে সারাদিনের জন্য রেডি হয়ে আমার দুইজন রুমমেটকে নিয়ে বের হই ব্রেকফাস্ট করতে। ব্রেকফাস্ট করতে বের হলেও আমি ক্যান্টিনে গিয়ে বসেই থাকি। ওখানে একদিনও আমি ব্রেকফাস্ট করিনি। তো আমার বন্ধুরা সবাই ব্রেকফাস্ট শেষ করার পর আমরা সবাই মিলে হলরুমে যাই। তখন বাজে সকাল ৯টা। শুরু হয় আমাদের ৫ নম্বর ওয়ার্কশপ। এটা একইসাথে শিক্ষণীয় আর উপভোগ্য ছিল। এটার নাম ছিল প্ল্যানেট ওয়াক। এই ওয়ার্কশপে প্রথমেই আমাদেরকে কিছু ইন্সট্রাকশন শিট দেওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া থাকে। তারপর একজন ইন্সট্রাকটর আমাদেরকে শিখিয়ে দেন কীভাবে কী করতে হবে। আমরা সেই সকল নির্দেশনা অনুসারে ইন্সট্রাকশন শীটে থাকা খালিঘরগুলো আমাদের বের করা ডেটা দিয়ে ফিলআপ করি। তারপর ৬/৭ জনের গ্রুপ করে করে স্লাইড ক্যালিপার্স ব্যবহার করে ক্লে দিয়ে আমাদের বের করা মান অনুযায়ী একেক গ্রুপ আমাদের সোলার সিস্টেমের একেকটা গ্রহের মডেল বানাই। তারপর সেগুলো নিয়ে যাই আমাদের ইন্সট্রাক্টরের কাছে। উনি সেগুলো কালেক্ট করে আমাদেরকে নিয়ে যান মাঠে প্ল্যানেট ওয়াক করাতে। কি যে রোমাঞ্চকর ছিল সেটা!
প্ল্যানেট ওয়াকের পর আমাদেরকে প্রায় ৩০ মিনিটের জন্য একটা ব্রেক দেওয়া হয়। তখন আমরা কিছু স্ন্যাকস, ড্রিংকস, ফল – এসব খেয়ে নিই। ব্রেকের পর শুরু হয় আরও একটি মজার ওয়ার্কশপ; ওয়ার্কশপ-৬। এটার নাম ছিল পাওয়ার-অফ-টেন, যার জন্য প্রথমে প্রতিটা গ্রুপকে একটা করে বক্স দেওয়া হয়, যেটার ভেতরে ৮টি করে ৬টি কালারের কার্ড ছিল। একে একে সবগুলো কালার নিয়েই আমরা কাজ করি। কার্ডগুলো ছিল মহাবিশ্বের বিভিন্ন বস্তুর আকার সংক্রান্ত। আমাদের টাস্ক ছিল সেগুলোকে ছোট থেকে বড় অনুসারে সাজানো। তো সাজানোর পর আমাদের সবাইকে সেইম কার্ডগুলোই কিন্তু আরও বড় আকারের একটা করে দেওয়া হয়। আমরা সেগুলো নিয়ে আকারের ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী দাঁড়িয়ে পড়ি। তারপর একজন ইন্সট্রাকটর একটা একটা কার্ড করে সিরিয়ালি অল্প কিছু আলোচনা করে যান। এরই মধ্য দিয়ে শেষ হয় ৬ নম্বর ওয়ার্কশপটি। তারপর আমরা লাঞ্চ করি।
লাঞ্চ শেষে আমাদেরকে এত্ত সুন্দর একটা জায়গা দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয় যেটা আমি কখনোই ভুলব না। তো আমরা যাই টুইন প্যাগোডাতে। এত এত ফুলের বাগান, পাহাড়ের উপরে দুই পাশে দুইটা বৌদ্ধমন্দির, কি যে সুন্দর ছিল! সেখানে আমাদেরকে দেড় ঘন্টা সময় দেওয়া হয় নিজেদের মতো করে টুইন প্যাগোডা ও এর আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্য। আমরা তখন পুরোটা ঘুরে দেখি, ছবি তুলি, আনন্দ করি, খুব মজা করি। আর এত্ত সুন্দর দৃশ্য দেখে আমি খালি মুগ্ধ হয়েই যাচ্ছিলাম। কত রকমের যে ফুলগাছ লাগানো ছিল! দেখতে দেখতে দেড় ঘণ্টা ফুরিয়ে যায় আর আমাদেরকে টুইন প্যাগোডা ছেড়ে আসতে হয়।
তখন বাজে বিকাল ৩টা ৩০। আমরা সেখান থেকে রওয়ানা দেই থাই ন্যাশনাল অব্জার্ভেটরিতে যাওয়ার জন্য। প্রায় ৩০ মিনিটের মতন সময় লাগে সেখানে পৌঁছাতে। সেখানে পৌঁছানোর পর আমাদেরকে আসিয়ান অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ৪০-মিটার রেডিও টেলিস্কোপ ও অব্জার্ভেটরি দেখানো হয়, সেগুলোর বিভিন্ন অংশ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হয়। এসব শিখতে শিখতে কখন যে আরও দেড় ঘন্টা কেটে যায় টেরই পাইনি।
তারপর শুরু হয় খুবই অনন্যসাধারণ একটা এক্সপেরিমেন্ট। আমাদের ক্যাম্পের ৭ নম্বর এবং সর্বশেষ ওয়ার্কশপ; ক্রায়োজেনিক শো! এই ওয়ার্কশপে আমাদেরকে দেখানো হয় তরল শীতল নাইট্রোজেনের খেলা। এক্সপার্টরা যখন গাছের পাতা, সূর্যমুখী ফুল এসব চোখের পলকে তরল নাইট্রোজেনে ডুবিয়ে সেটাতে এক বাড়ি দিয়ে গ্লাস ভাঙার মতো করে টুকরো টুকরো করে ফেলছিল আমরা সবাই অবাক হয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছিলাম আর সেই সবকিছু খুব উপভোগ করছিলাম। এরপর শুরু হয় আসল পার্ট। তরল নাইট্রোজেন দিয়ে আমাদের জন্য আমাদের চোখের সামনে মজার আইসক্রিম বানানো হয়। একজন এক্সপার্ট এই কাজটি করেন। উনি যখন আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম বানানোর জন্য একটার পর একটা উপাদান মেশাচ্ছিলেন আমরা তখন খুশিতে-আনন্দে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। আর সবশেষে যখন তরল অতিশীতল নাইট্রোজেন যোগ করছিলেন সেটা অত্যন্ত চমৎকার একটা অংশ ছিল। এভাবে আইসক্রিম বানানো শেষ হলে এক্সপার্ট আমাদের সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন যে কে আগে ট্রাই করতে চায় সেই বিশেষ দুর্লভ আইসক্রিম। অতি উৎসাহ নিয়ে আমি সবার আগে হাত তুলি। এখনো ভাবলে খুশি লাগে যে সবার আগে ঐ আইসক্রিমটা টেস্ট করার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম।
যখন আমি আইসক্রিমটা মুখে দিচ্ছিলাম সবাই এক ঝাঁক কৌতূহল নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল আইসক্রিমটা খেতে কেমন সেটা জানতে। আইসক্রিমটা মুখে দেওয়ার পর এর টেস্টটা সাধারণ আইসক্রিমের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন মনে হয়েছিল, তবে খারাপ ছিল না। এক্সপার্ট আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে আমি এটাকে ১০-এ কত দিব। সততার সাথে উত্তর দিয়েছিলাম যে টেস্টের দিক থেকে ৭ দিব তবে এর দুর্লভতা ও অনন্য অসাধারণত্বের দিক থেকে এটা যেকোনো আইসক্রিমের চেয়েই সেরা। তারপর সবাইকেই দেওয়া হয় সেই আইসক্রিম। আইসক্রিম খাওয়া শেষ হলে আমরা সবাই মিলে ছবি তুলি অব্জার্ভেটরির সামনে দাঁড়িয়ে। ছবি তোলা শেষ হলে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় এর আগের দিনের মতো থাইল্যান্ডের সবচেয়ে উঁচু পয়েন্টে। তবে তখনও সন্ধ্যাই হয়নি। আমাদেরকে এরকম সময়ে সেখানে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ঐ জায়গাটা আর এর আশেপাশের সুন্দর জায়গাগুলো ঘুরিয়ে দেখানো। যেহেতু আমি জংগল, গাছপালা এসব অনেক পছন্দ করি তাই সেই জায়গাটা আমার কাছে খুব সুন্দর লেগেছিল। ওখানে কাঠের তৈরি একটা পথ করা ছিল জংগলের ভেতর দিয়ে। সেটা আমরা প্রায় সবাই খুব পছন্দ করেছিলাম। ওটার একটা ইন আর আউট পথ ছিল পাশাপাশি। ইন পথটা দিয়ে প্রবেশ করে অনেকটা পথ ঘুরে-ফিরে আউট পথ দিয়ে একই জায়গায় ফিরে এসেছিলাম আমরা। অনেকটা এডভেঞ্চারের মতো ছিল এটা। তারপর আমরা যাই ডিনার করতে। যদিও আমরা মুসলিম যারা ছিলাম তাদের জন্য সেটা ছিল ইফতার। ক্যাম্পটা যেহেতু রোজার মাসে হয়েছিল তাই সেখানে মুসলিম পার্টিসিপেন্টদের জন্য সেহেরি, ইফতার এসবের ব্যবস্থাও ছিল। যাই হোক, ডিনার সেড়ে আমরা আগের দিনের মতো আবার সেই হাড়কাঁপানো শীতে স্টারগেজিঙের জন্য যাই। সেদিনের স্টারগেজিঙে গেইম ছিল, গ্রুপভিত্তিক কম্পিটিশন ছিল। এইসব মজাদার এক্টিভিটি স্টারগেজিংকে অন্য লেভেলে নিয়ে গিয়েছিল। এসবের মাঝে আবারও দেওয়া হয় একটা কফি ব্রেক। প্রায় হিমশীতল ঠাণ্ডায় গরম গরম কফি আর স্ন্যাকস যেন আমাদের মাঝে নতুন করে কিছুটা প্রাণসঞ্চার করে দিয়েছিল।
সেদিন রাতে স্টারগেজিং শেষে আমাদের সবাইকে একসাথে করে ছবি তোলানো হয়, গ্রুপভিত্তিক ছবি তোলানো হয়, এছাড়া কিছু মজার মজার টাইপের ফটোশুটও করানো হয় প্রতিটা গ্রুপের। আমরা যেহেতু ছয় নাম্বার গ্রুপে ছিলাম তাই আমাদের গ্রুপফটোটা তোলা হয়েছিল সবার লাস্টে। আমরা ৮ জন মিলে সেই ছবিতে আমাদের গ্রুপের নাম বানিয়েছিলাম যেটা ছিল ফ্রেন্ডস৬। তো এসবের মধ্য দিয়েই শেষ হয় আমার ক্যাম্পের সর্বশেষ স্টারগেজিং।
আস্তে আস্তে অনুভব হচ্ছিল ক্যাম্পের এই ৩টা দিন কেমন করে চোখের পলকেই শেষ হয়ে গেল। ভেবে খুব ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছিলাম যে ঠিক একই জায়গায় আর কখনোই এই একই মানুষগুলো একত্রিত হবে না দূর বিশ্বে দুরবিন দিয়ে উঁকি মারার জন্য। মুহূর্তেই যেন হাসিখুশির মুহূর্তগুলো কিছুটা বেদনাবিধুর হয়ে উঠল। মনে মনে একটা ইচ্ছাই কামনা করছিলাম, যদি এই জায়গায় ঠিক একইভাবে আমাদের আবারও সাক্ষাৎ হতো! কিন্তু সেটা হয়ত অন্য কোনো প্যারালাল ইউনিভার্সেই আবার সম্ভব হয়ে উঠবে।
স্টারগেজিং পর্ব শেষ হওয়ার পর আমরা গাড়ি করে ফিরে যাই আমাদের যার যার রুমে। গিয়ে ফ্রেশ হয়েই কাজ শুরু করে দেই প্রেজেন্টেশন নিয়ে। আবারও আমার রুমে বসে প্রায় রাত ২টা পর্যন্ত আমরা কাজ করি। পোস্টার কালার করা বাকি ছিল সেটা করি। তাছাড়া স্ক্রিপ্ট রেডি করি। কোন অংশটা কে বলবে সেগুলো ভাগ করে নিই। এইতো এসবই। আর তারপর সবাই যার যার রুমে চলে যায়। আমার রুমে আমি আর আমার রুমমেটরা তখন নিজেদের ব্যাগ প্যাক করছিলাম। সকালেই যে বেড়িয়ে পড়তে হবে। ক্যাম্পও ইতি টানবে। সেদিন রাতে আমরা আড্ডা দিই, একে-অপরের প্রতি যে মায়াটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেগুলো ব্যক্ত করার চেষ্টা করি, স্মৃতিকাতর হই, কতই না মিশ্র অনুভুতি কাজ করছিল সেই রাতে! সকালে ঘুম ভাঙতে আমাদের কিছুটা দেরি হয়ে যায়। ঝটপট রেডি হয়ে আমরা সোজা চলে যাই আবার সেই এস্ট্রোনমারস লজে। যেতে না যেতেই শুরু হয়ে যায় প্রেজেন্টেশন পর্ব। তার উপরে সেটা শুরু হয় উল্টো থেকে মানে গ্রুপ-৬ থেকে অর্থাৎ আমাদের গ্রুপ থেকে। আর প্রেজেন্টেশন শুরু করার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। তাই গিয়ে একটু স্থির হওয়ারও অবকাশ পেলাম না। দিতে হলো প্রেজেন্টেশন। তো আমাদের প্রেজেন্টেশনের টপিক ছিল দ্য লুনার হোটেল! ইন্টারেস্টিং, তাই না? তো আমি প্রথমে ইন্ট্রোডাক্টরি পার্টটা বলে আমার গ্রুপের পরবর্তী বক্তার হাতে মাইক তুলে দিই। এভাবে একে একে ৭ জনই বলে। আমাদের মোট সেগমেন্ট ছিল আটটা। আমি সবশেষে আমাদের লুনার হোটেলের ভেতর কীভাবে বায়ু ও অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা করা হবে সেটা বলি এবং প্রেজেন্টেশনের শেষ অংশটা বলে আমাদের প্রেজেন্টেশন শেষ করি। সবাই জোড়ে হাততালি দিয়ে আমাদের প্রশংসা করেছিল। তখন খুব ভাল লাগছিল কারণ আমি ব্যক্তিগতভাবেও এই প্রেজেন্টেশনটা নিয়ে খুব সিরিয়াস ছিলাম। গ্রুপ মেম্বারদেরকে একত্র করা, কীভাবে কী কী করতে হবে, কখন করতে হবে সেগুলোর আউটলাইন বের করা – সব মিলিয়ে ভাল সময়ই দিয়েছিলাম এটার পেছনে। আর তাই যখন সবাই আমাদের প্রেজেন্টেশনটার প্রশংসা করেন তখন আমার কাছে খুশিই লাগছিল। এভাবে একে একে সবগুলো গ্রুপই তাদের প্রেজেন্টেশন দেয়। সবারগুলোই খুব উপভোগ করছিলাম।
এরপর শুরু হয় আমাদের সেই প্রথম দিন থেকে শুরু হওয়া ট্রিকস গেইমটার সমাপ্তির পালা। তখন দেখি যে আসল ট্রিকস তো এক্সপার্ট আর ইনস্ট্রাক্টররা করেছেন আমাদের সাথে! যারা ক্রুমেট তারা আসলে কিছুই পাইনি। অন্যদিকে যাদের কাছে এলিয়েন আর ব্ল্যাকহোল কার্ড ছিল তাদেরকে সামনে নিয়ে কিছু গিফট দেওয়া হয়েছিল। আর আমরা যারা এত কাহিনী করে অন্যকে ট্রিক করে, অন্যের ট্রিক থেকে বেঁচে থেকে ক্রুমেট কার্ডটি ম্যানেজ করেছিলাম তারা আসলে কিছুই পাইনি। তারা আমাদের সাথে আরও একটা ট্রিক করেছিল। আমরা সবাই খুব সিরিয়াস হয়ে গ্রুপ প্রেজেন্টেশনের কাজ করেছিলাম, ভেবেছিলাম যে এর কোনো বিজেতা গ্রুপ ঘোষণা করা হবে। কিন্তু হতাশ! তারা আমাদেরকে দিয়ে প্রেজেন্টেশনের কাজ করিয়ে নিয়েছে ঠিকই কিন্তু শেষে কোনো বিজয়ী দল ঘোষণা করেননি। তবে ভালই ছিল ওদের ট্রিকটা। এই প্রেজেন্টেশনের কাজ করতে গিয়ে আমরা অনেক কিছু শিখেছি।
শেষ হয়ে গেল ক্যাম্পের প্রায় সকল কার্যক্রম। আমরা সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। একে অপরকে ছোট বার্তা লিখে দিচ্ছিলাম, ছবি তুলছিলাম, একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা অনুভব করছিলাম; খুব গভীর! কিন্তু সেটা কী তা ভাষায় যেন প্রকাশ করে উঠতে পারছিলাম না। আমাদেরকে আরও বেশি আবেগপূর্ণ করে দিলো ক্যাম্প অথরিটি কর্তৃক বানানো একটি ভিডিও, যেটাতে ক্যাম্পের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি ছিল। এসব দেখে আমরা আরও বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়ি।
তারপর আমাদেরকে একটা সুযোগ দেওয়া হয় ক্যাম্প আর সকলের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলার থাকে তাহলে সেটা বলার জন্য। তো প্রথমে আমি বলি। তারপর আরও কয়েকজন বলে। এরপর আমাদেরকে আমাদের সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। শেষ হলে গেল এএসি-২০২৫!
এ যেন কেবলই কোনো ক্যাম্পের সমাপ্তি ছিল না, এটা এর চেয়েও অনেক গভীর, অনেক প্রবল কিছু ছিল। তবে এরপর আমাদেরকে লাঞ্চ করানোর জন্য একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এর আগেই কয়েকজন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে। আমরা বাকিরা লাঞ্চ সেড়ে কেউ কেউ এস্ট্রো পার্কে যাই আবার কয়েকজন সেখান থেকে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে বেড়িয়ে পড়ে। এস্ট্রো পার্কে গিয়ে সেখানে আমি কয়েকটা ছবি তুলি আর তারপর আমার একটা বন্ধুর সাথে ক্যাম্প থেকে বিদায় নিই। খুব খারাপ লাগছিল তখন। কত তাড়াতাড়ি সবকিছু শেষ হয়ে গেল! ক্যাম্প থেকে বিদায় নিই দুপুর প্রায় ১টার দিকে। আমার ব্যাংকক ফিরে যাওয়ার ট্রেন ছিল বিকাল ৫টায়। তাই আমি আর আমার বন্ধু সাৎছ্শা মিলে ঠিক করলাম যে এই ফাঁকে আমরা চিয়াং মাই ইউনিভার্সিটিতে যাব। তো চলে গেলাম ট্যাক্সি নিয়ে কিন্তু সেখানে আমি যেই জায়গাটা দেখতে চাচ্ছিলাম সেটা দেখতে পারিনি। একটা লেক ছিল ক্যাম্পাসের ভেতরে সেটাই দেখতে চাচ্ছিলাম আমরা। কিন্তু সেটা একপ্রকার দূরেই ছিল আর আমাদের সাথে ব্যাগ থাকায় আর খুব রোদ থাকায় আমরা হেঁটে আর সেখানে যেতে পারিনি। তবে সেখানে আমি যখন ঘুরে ঘুরে ঐ ভার্সিটির ক্যাম্পাসটা দেখছিলাম তখন হঠাৎই একটা হলরুম থেকে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর শব্দ শুনতে পেলাম। কৌতূহলবশত দরজায় গিয়ে কড়া নাড়তেই একটা ছেলে বের হয়ে আসলো। সে বয়সে আমার ছোট ছিল। ক্লাস নাইনে পড়ে ও। ওর নাম বুক (Book)। তারপর ও আমাকে ওদের মিউজিক রুমে নিয়ে গিয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দেখায়, আমাকে একটা বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখিয়েও দেয়। খুব ভাল ব্যবহার ছিল ওর। একপ্রকার বন্ধুত্ব হয়ে যায় ওর সাথে আমার। শেষে ওর সাথে একটা ছবি তুলে সেই স্মৃতি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে। ট্যাক্সি নিয়ে আমি আর সাৎছ্শা চিয়াং মাই রেলস্টেশনে যাই। সাৎছ্য়ার ট্রেন ছিল আমার এক ঘন্টা পরে। তো আমি গিয়ে আমার ট্রেনে উঠি। সারারাত ট্রেনে করে সকালে গিয়ে পৌঁছাই ব্যাংকক। ওখানে রেলস্টেশনে বসে অপেক্ষা করি কৃষি আর সাৎছ্শার জন্য। প্রায় একঘন্টা পর ওদের ট্রেন এসে পৌঁছোয়। সেখানে কৃষি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়। কৃষি চলে যাওয়ার পর আমি আর সাৎছ্শা কিছুক্ষণ রেলস্টেশনে বসে থাকি, আড্ডা দিই, আমাদের ফোন চার্জ করে নিই আর তারপর সাড়ে নয়টার দিকে রওয়ানা দিই ব্যাংকক সূবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য। দেশে ফেরার সময় হয়ে আসলো যে! ফ্লাইট ধরতে হবে! ছেড়ে যেতে হবে থাইল্যান্ড আর সেই সোনালী সময়গুলো। সাথে কেবল আনতে পেরেছি হাজারো অমূল্য স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা আর এক ঝাঁক ভালোবাসা।
এয়ারপোর্টে পৌঁছেই সাৎছশার থেকে বিদায় নিই। ওর ফ্লাইট ছিল আমার পরে। সাৎছ্শা এসেছিল কম্বোডিয়া থেকে, ও বয়সে যদিও আমার ছোট কিন্তু ক্যাম্পের একদম শুরু থেকে শেষ অবধি ওর সাথে বন্ধুর মতোই ঘুরেছি। ওর সাথেই আমার সবার আগে দেখা হয় হোটেলে পৌঁছে। এছাড়া ফুগা, কৃষি, আমার রুমমেট সোরা, টিমমেট সাই, তারপর প্যাং, আইনাম, শন-এদের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয় আমার। আমরা একসাথে চিয়াং মাই চিড়িয়াখানায় যাই, আরও বেশ কয়েকটা জায়গায় ঘুরি। কতই না মজা করেছি সেই সময়গুলোত। এছাড়া বাকি সবার সাথেই বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। এখন আমার এই বন্ধুরা সবাই কত দূরে! একেকজন একেক দেশে। দূরের সেই বন্ধুদের দেখা আবার কখন পাব কে জানে। সবাইকে খুব মিস করি আমি। ইন্টারনেটের দৌলতে এদের সাথে অনলাইনে যোগাযোগ থাকলেও ক্যাম্পের সেই দিনগুলি ছিল অতুলনীয়। এবার বাংলাদেশ থেকে কেবল আমিই পার্টিসিপেট করতে পেরেছিলাম। যদিও আমার সাথে আরও দুইজন আমাদের দেশ থেকে এটার জন্য সিলেক্টেড হয়েছিল; রোহান পাল ও আরীব বিন ফারুক। কিন্তু কিছু ব্যাক্তিগত কারণে ওরা ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।
আমার জন্য এই ক্যাম্পটা কেবলই একটা ক্যাম্প ছিল না। সিলেক্টেড হওয়ার পর যখন আমার আম্মু বলল যে আমাকে পাঠাবে তখন চারপাশ থেকে কিছু কথা খুব শুনতে হয়েছিল, “ও মেয়ে মানুষ একা একা থাইল্যান্ড যাবে! ও কি পারবে? ওকে দেখতে তো মনে হয় না যে ও এসব ম্যানেজ করতে পারবে। মেয়ে মানুষদের একা ছাড়তে নেই। কোনো বিপদ হলে?” এরকম আরও অনেক কিছু। কিন্তু আমি আমার আম্মু আর আল্লাহর সহযোগিতায় প্রমাণ করতে পেরেছি একজন মানুষের সক্ষমতা তার জেন্ডারের বা আউটলুকের সাথে সংশ্লিষ্ট না, বরং তার ইচ্ছাশক্তি ও মনোবলের উপর নির্ভর করে। এই ক্যাম্পের মাধ্যমে আমি শুধু আমার পছন্দের বিষয় জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েই শিখিনি, এর পাশাপাশি এই ক্যাম্পটা ছিল আমার জন্য নিজেকে প্রমাণ করার একটা পথ। মেয়েদেরকে নিয়ে আমাদের সমাজের প্রচলিত চিন্তাভাবনাকে ভুল প্রমাণ করার একটা উপায়। দূর দেশে গিয়ে দূর বিশ্বের দূরের কথা শোনার ও শোনানোর এক অমূল্য সুযোগ ছিল আমার জন্য এই এএসি-২০২৫!
Leave a Reply
Want to join the discussion?Feel free to contribute!